অমৃতপাল সিং হত্যার আসল কারন জানালো কানাডা

অমৃতপাল সিং হত্যার কারন কি

অমৃতপাল সিং হত্যার কারন কি! ভারতের শিখ সম্প্রদায়ের একটা অংশ ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যকে নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ গঠন করতে চায়। তারা এই দেশের নাম রাখতে চায় খালিস্তান যার অর্থ বিশুদ্ধ ভূমি। খালিস্তান আন্দোলনের প্রস্তাবনায় এ দেশের সীমানা নিয়ে কিছুটা মতবিরোধ রয়েছে।

কেউ কেউ বলে থাকেন শুধুমাত্র ভারতের পাঞ্জাব রাজ্যই হবে খালিস্তান। আবার অনেকে মনে করে থাকেন ভারত-পাকিস্তান উভয় দেশের পাঞ্জাব রাজ্য এবং এর পার্শ্ববর্তী রাজ্যের কিছু অঞ্চল জুড়ে খালিস্তান গঠন করা উচিত। মুঘল সম্রাট দুর্বল হওয়ার পর এবং ব্রিটিশরা পাঞ্জাব দখল করার আগে শিখ জাতি প্রায় ৮২ বছর এই অঞ্চলে স্বাধীন রাষ্ট্র পরিচালনা করে।

খালিস্তান  আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ১৯৮০ র দশকে ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলে ব্যাপক অস্থিরতা দেখা গিয়েছিল। তবে এই আন্দোলনের বীজ রোপন করা হয়েছিল দেশভাগের আগে। তবে এখানে বলে রাখা ভালো ভারতের পাঞ্জাব অঞ্চলের অধিকাংশ ব্যক্তি খালিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন করে না।

বর্তমানে যেসব প্রবাসী শিখরা রয়েছে তারা সবচেয়ে বেশি খালিস্তান  আন্দোলন নিয়ে মাথা ঘামিয়েছে। খালিস্তান আন্দোলন কিভাবে শুরু হয়েছিল এবং এই আন্দোলনের কারণ কি সেই সম্পর্কে আজকের এই পোস্টের মাধ্যমে আপনাদেরকে বিস্তারিত জানানো হবে।

শিখ ধর্মের অনুসারী সংখ্যা

১৫ শতকের দিকে গুরু নানুতদের শিখ ধর্মের প্রবর্তন করেন। যেসব ব্যক্তি শিখ ধর্ম অনুসরণ করে তাদেরকেও শিখ বলা হয়। সংস্কৃত ভাষার শীর্ষ শব্দটি থেকে শিখ শব্দটির আবির্ভাব ঘটেছে। কেননা একজন শিখ তার গুরুর অনুসারী হয়ে থাকে যার কারণে এই নামকরণ করা হয়েছে।

বিশ্বজুড়ে প্রায় ২৫০ কোটিরও বেশি শিখ ধর্মাবলী ব্যক্তিবর্গ রয়েছে ।অনুসারীর তালিকা অনুযায়ী শিখ ধর্ম বিশ্বের মধ্যে অষ্টম স্থানে রয়েছে। ভারতের মোট জনসংখ্যার ২.৫ শতাংশ এই ধর্মের অনুসারী। আবার এই ধর্মের অধিকাংশ অনুসারী প্রবাসী হয়েছে।

ভারতের বাইরে সবচেয়ে বেশি শিখ ধর্মাবলী অনুসারীরা বসবাস করে কানাডায় যার পরিমাণ প্রায় ৭ লাখ ৫০ হাজারেরও বেশি। যেটি কানাডার মোট জনসংখ্যার প্রায় ২% এরও বেশি। এর বাইরেও যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৫ লাখ এবং অস্ট্রেলিয়ায় প্রায় ২ লাখেরও বেশি শিখ ধর্মাবলিক জনসংখ্যা বসবাস করে।

শিখ মিশল কি

মুঘল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা বাবরের আমলে প্রথমবারের মতো শিখ ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছিল। আর তখন থেকেই শিখ ধর্মাবলীরা পাঞ্জাব রাজ্যে বসবাস করত।

তৃতীয় মুঘল সম্রাট আকবরের সঙ্গে শিখ ধর্মাবলী শীর্ষ নেতাদের খুব ভালো সম্পর্ক ছিল। পরবর্তীতে সম্রাট জাহাঙ্গীর এই নেতাদের রাজনৈতিকভাবে দমন করেন এবং পরবর্তীতে সম্রাট শাহজাহান শিখদের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনে সরাসরি বাধা প্রদান করেন।

১৭৬০ সালের সম্রাট আওরঙ্গ দেব মৃত্যুবরণ করলে মুঘল সাম্রাজ্য তখন দুর্বল হতে শুরু করে আর ঠিক সেই সময় থেকেই শিখ সম্রাজ্যের পুনরায় উৎপত্তি শুরু হয়। ১৭৬৭ থেকে ১৭৯৯ সালের মধ্যে পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে ছোট ছোট শিখ রাজ্য গড়ে উঠতে থাকে। যা তখনকার সময়ে শিখ মিশল হিসেবে পরিচিত ছিল।

১৭৯৯ সালে মহারাজা রঞ্জিত সিং ছোট ছোট শিখ রাজ্যগুলোকে একত্রিত করে এবং লাহোরকে পাঞ্জাবের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৮০১ সালে শিখ সাম্রাজ্য্য আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছিল এবং শিখ সম্রাজ্যের চারপাশে আরও অন্যান্য হিন্দু এবং মুসলিম বসবাস করত। ১৮৩৯ সালে রঞ্জিত সিং মৃত্যুর পর শিখ সম্রাজ্যের রাজনৈতিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পরে।

১৮৪৫ সালের শিখরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সঙ্গে প্রথম যুদ্ধে জোড়ায় যে যুদ্ধে শিখ সম্রাজ্যে পরাজিত হয় এবং কিছু সংখ্যক এলাকা ইংরেজদের অনুকূলে চলে আসে। পরবর্তীতে ১৮৪৯ সালে পুনরায় ইংরেজিদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হলে শিখ সম্রাজ্যে বিলুপ্ত হয়ে যায়।

খালিস্তান নামকরনের কারন

১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যখন মুসলিমদের জন্য একটি সম্পূর্ণ আলাদা রাজ্যের দাবী জানায়, তখন শিখ নেতারা ভাবতে থাকেন হিন্দু এবং মুসলিমদের দুটি দেশে ভাগ করলে শিখ সম্প্রদায়ের কোন স্বাধীন রাষ্ট্র থাকবে না। আর এর ফলে তারা তখন পাঞ্জাব রাষ্ট্রকে শিখিস্তান নামে পরিচিতি দিয়ে নতুন রাষ্ট্রের ধারণা প্রদান করেন। আর এই শিখিস্তানই ১৯৮০ দশকে খালিস্তান নামে ব্যাপক পরিচিত লাভ করে।

শিখ নেতারা অনেকেই মনে করেন যে শিখ সম্রাজ্য সবসময়ই একটি স্বাধীন এবং সার্বভৌমত্ব রাষ্ট্র ছিল। পাঞ্জাব রাজ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনে আসার কারণে তারা ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

দ্বিজাতি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সময় পাকিস্তান থেকে অনেক শিখ ভারতে চলে আসে। আর এর ফলে পাকিস্তানের পাঞ্জাব রাজ্যে শিখ সম্প্রদায় সংখ্যালঘু হয়ে পড়ে। আর অনেক শিখ নেতারাই তখন মনে করে দেশভাগের কারণে তারা এমন পরিস্থিতির শিকার হয়েছে। ফলে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়। কিন্তু তারা সেই যুদ্ধে পরাজিত হয়।

পাঞ্জাবি সুবা আন্দোলন

দেশভাগের পর পাঞ্জাব রাজ্যের মধ্যে সংগঠন পাঞ্জাবি সুবা আন্দোলন শুরু করে। এই আন্দোলনের মূল ভিত্তি ছিল পাঞ্জাবি ভাষার উপর নির্ভর করে একটি আলাদা রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা।

প্রথমদিকে এই আন্দোলনকে তেমন গুরুত্ব না দিলেও দীর্ঘ ১৯ বছর ধরে চলা এই আন্দোলনে ব্যাপক সহিংসতা দেখা দেয় এবং অনেক নিরীহ মানুষ এতে প্রাণ হারায়। অবশেষে ১৯৬৬ সালে ইন্দ্রাগান্ধির সরকার পাঞ্জাবকে তিনটি রাজ্যে বিভক্ত করেন। একটি হলো পাঞ্জাব পাশাপাশি শিখ রাজ্য। আরেকটি হিন্দি ভাষা হরিয়ানা এবং সর্বশেষ তৃতীয় অঞ্চলটি হল চন্ডিগড়। আর এই চন্ডিগড়কে পাঞ্জাব এবং হরিয়ানার রাজধানী হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু এই সিদ্ধান্তকে অনেকেই সাধুবাদ জানাতে অশ্বিকৃতি জানায়।

কেননা দুটি রাজ্যের জন্য একটি রাজধানী নির্ণয় এবং কিছু কিছু অঞ্চল পাঞ্জাবের অধীনে না থাকার কারণে আরেকটি নতুন আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৭৭ সালে পুনরায় পাঞ্জাবকে সাহিত্য শাসিত করার জন্য আন্দোলন শুরু করে সেখান কার নেতারা। জাকে আনন্দপুর সায়িব প্রস্তাব নামে ডাকা হয়।

জার্নাল সিং এর উত্থান ও অপারেশন ব্লু এস্টার

এই প্রস্তাবের মাধ্যমে শিখদের স্বাধীন সংবিধান তৈরীর অধিকার চাওয়া হয়। ১৯৮০ দশকে এই দাবি ঐ অঞ্চলে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তখন জার্নাল সিং নামের এক শিক নেতা এই আন্দোলনকে আরো রক্তক্ষয়ী করে তুলুন। তিনি আকালি দলের সাহিত্য শাসনের পক্ষে ছিলেন না।

তিনি মূলত শিকদের জন্য আলাদা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। আর এ কারণেই খুব অল্প সময়ে পাঞ্জাবের সকলের কাছে তার জনপ্রিয়তা বাড়তে থাকে। জার্নাল সিং ১৯৮২ সালে আকালী দলের সঙ্গে যুক্ত হয়ে ভারত সরকারের আইন অমান্য করার আন্দোলন শুরু করেন।

আর এর ফলে পাঞ্জাব রাজ্যের আইন-শৃঙ্খলার ব্যাপক অবনতি ঘটে। এমনকি জার্নাল সিং হিন্দু ধর্মের বিপক্ষে অনেক স্পর্শকাতর মন্তব্য করে বসেন। অনুসারীরা সেই সময় অন্য ধর্মের ব্যক্তিদের উপর ব্যাপক হামলা চালায় এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপর ক্রমাত হয়ে ওঠে।

আর এসব কর্মকাণ্ডের জন্য সরকার যেন তাকে গ্রেপ্তার করতে না পারে এই জন্য তিনি পাঞ্জাব রাজ্যের সবচেয়ে পবিত্র মন্দিরে অবস্থান করেন। ভারত সরকার এ ব্যাপারে দুই বছর যাবত কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কিন্তু সর্বশেষ ইন্দিরা গান্ধী সরকার অপারেশন ব্লু এস্টার নামে সেনাদলের সাহায্যে স্বর্ণমন্দিরি অভিযান চালায়।

কিন্তু শিখদের প্রতিরোধ এত ব্যাপক আকারের ছিল যে সেনাবাহিনী সর্বশেষ বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপ করতে বাধ্য হয়। জুন মাসের এক থেকে দশ তারিখের মধ্যে চলা এই অভিযানে প্রায় ৮৩ জন ভারতীয় সেনা মারা যায় এবং ২৪৯ জন আহত হয়। অপরদিকে ৪৯৩ জন শিখ জঙ্গি নিহত হয়।

এই অপারেশনের প্রতিশোধ হিসেবে চার মাস পর ইন্দিরা গান্ধী সরকারকে গুলি করে হত্যা করা হয়। আর এই হত্যাকাণ্ড মূলত ইন্দিরা গান্ধীর দেহরক্ষী দুজন ঘটিয়েছে। যারা মূলত শিখ সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আর এর ফলে ভারত জুড়ে শিখবিদ্বেষী দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। আর এতে ৮ হাজারেরও বেশি শিখ নিহত হয়।

শিখদের বিভিন্ন জঙ্গি হামলা

১৯৮০ দশকে খালিস্থান আন্দোলন দমনের পর শিকরা দেশে এবং দেশের বাইরে বেশ কিছু জঙ্গি হামলা পরিচালনা করে। কানাডায় বসবাসকারী শিখরা জার্নাল সিংহ হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ১৯৮৫ সালে এয়ার ইন্ডিয়ার একটি বিমানে বোমা হামলা চালায়। আটলান্টিক মহাসাগরের উপর বিস্ফোরিত সেই বিমানের ৩০০ আরোহীর সকলেই মারা যায়। ১৯৮৬ সালে ভারতের সেনাপ্রধানকে হত্যা করা হয়। ১৯৯৫ সালে গাড়ি বোমা বিস্ফোরণের মাধ্যমে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীকে হত্যা করা হয়।

বর্তমানে ভারতে অবস্থানরত অনেক শিখ স্বাধীন খালিস্তান আন্দোলনকে স্বীকৃতি দেয় না। তবে বিদেশে বসবাসরত অনেক শিখ খালিস্তান আন্দোলনের জন্য এখনো বিভিন্ন ধরনের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। যা গেল বছরগুলোতে অনেক আক্রমনাত্মক রূপ ধারণ করেছে।

১৯৮০ থেকে ৯০ দশকের মধ্যে ভারতের অনেক শিক নেতা যাদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তারা দেশের বাইরে অবস্থান করে। কানাড, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি এবং পাকিস্তানের বহু খালিস্তানপন্থী সংগঠন গড়ে উঠেছে। এগুলোর মধ্যে শিখ ফর জাস্টিস সংগঠনকে সবচেয়ে কুখ্যাত বলে মনে করা হয়।

ধারণা করা হয় এই সংগঠনটি পাকিস্তানের দ্বারা পরিচালিত হয়ে থাকে। কেননা পাকিস্তান ভুরাজনৈতিক কারণে সব সময় ইন্ডিয়ার সঙ্গে বৈরিতা তৈরি করে। বর্তমানে বিভিন্ন রাষ্ট্রে ভারতের দূতাবাসগুলোতে শিখ আন্দোলনকারীদের অবস্থান করতে দেখা গিয়েছে। এমনকি তারা মহাত্মা গান্ধীর মূর্তি পর্যন্তও ভেঙে ফেলেছে। সর্বশেষ ভারত শিখপন্থি নেতা অমৃতপাল সিং কে হত্যার মাধ্যমে এই আন্দোলনকে আরো জোরালো করেছে বলে অনিকে ধারণা।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top