পদ্মা সেতু নিয়ে A to Z সকল প্রশ্ন ও সাধারণ জ্ঞান

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ।পদ্মা,মেঘনা,যমুনা,কর্ণফুলী,সুরমা,কুশিয়ারা প্রভৃতি এদেশের কয়েকটি বড় বড় নদী।বিস্তৃততার বিবেচনায় নদীসমুহের মধ্যে মেঘনার পরই পদ্মার অবস্থান।

পদ্মা সেতু

হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে উৎপত্তি লাভ করে পদ্মা নাম ধারণ করে রাজশাহী জেলার বুক চিঁড়ে পদ্মা নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।এ নদীর সব্বোর্চ গভীরতা ১,৫৭১ ফুট (৪৭৯ মিটার) এবং গড় গভীরতা ৯৬৮ ফুট (২৯৫ মিটার)।বাংলাদেশে এ নদীর দৈর্ঘ ১২০ কিলোমিটার এবং গড় প্রস্হ ১০ কিলোমিটার।বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক এদেশে পদ্মা নদীর পরিচিতি নং ৩২। পদ্মানদীর এপাড় – ওপাড় জুড়ে রয়েছে বাংলাদেশের দক্ষিণের ২৯টি জেলা।

তন্মধ্যে নবাবগন্জ,রাজশাহী,নাটোর,মুন্সীগন্জ,মানিকগন্জ,পাবনা,কুষ্টিয়া,মাদারীপুর,শরিয়তপুর,ফরিদপুর,রাজবাড়ী ও চাঁদপুর প্রভৃতি জেলাসমুহ পদ্মা নদীর দুধারে অবস্হান করে। নদীর পাড়ের মানুষের কাছে জীবন এক দূর্বিষহ আপেক্ষিক নাম।তাদের না আছে ভালো কোনো যোগাযোগ ব্যবস্হা,না আছে জনজীবনের নিরাপত্তা।প্রকৃতির ভয়াল থাবায় নিমিষেই নিঃশেষ হয়ে যেতে পারে তাদের স্বাধের সাজানো জীবন।

অনেক সময় পদ্মার কোল ঘেঁষে মুন্সীগঞ্জ প্রান্তের মাওয়া ঘাটে দেখা যায় ফেরীর অপেক্ষারত শত শত মানুষ।ফেরী পারাপারের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষায় বিষিয়ে ওঠে জনজীবন অথবা দেখা যায় সঠিক সময়ে হাসপাতালে পৌঁছনোর ব্যর্থতায় রোগীবাহী গাড়ির গন্তব্য বদলে যায়।ফিরতে হয় লাশবাহী গাড়ি হয়ে।

পদ্মা সেতু A to Z, কত কিলোমিটার, টোল কত, পদ্মা সেতু সম্পর্কে সাধারণ জ্ঞান

এমন হৃদয় বিদারক ঘটনা পদ্মার পাড়ের মানুষের জন্য পরিচিত এবং সহনীয় একটি ঘটনা।তাদের এ ভাগ্য বিড়ম্বনা বদলানোর একমাত্র উপায় হিসেবে পদ্মা সেতুর বাস্তব রুপকে ধরে নেওয়া যায়।তাই পদ্মার পাড়ের ২১ জেলার মানুষের কাছে পদ্মা সেতু একটি আবেগের নাম,একটি নতুন দিগন্তের নাম।এটি এক সময় পদ্মার পাড়ের মানুষের প্রাণের দাবী হয়ে ধরা দেয়।পদ্মা সেতু ঘিরেই সোনালী স্বপনের বীজ বপন করা শুরু করে দেন এই অঞ্চলের মানুষ।পদ্মা সেতুর আর্বিভাবে ২১ জেলার মানুষের ভাগ্য বদলে নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে।

২১ জেলার জনসাধারণের এই স্বপ্নকে বাস্তবে রুপরেখা দান করার পরিকল্পনা করেন বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।সেতুর পাক সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে মাওয়া ঘাটকে সেতু নির্মাণের সবচেয়ে ভালো জায়গা হিসেবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশে পদ্মার উপর সেতু নির্মাণে ডিটেইল ইন্জিনিয়ারিং এর কাজ শুরু হয়।

প্রাথমিকভাবে ২০০১ সালে পদ্মা সেতুর ভিত্তি স্হাপন করেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।এরপরে সম্ভব্যতা যাচাইয়ের উপর ভিত্তি করে ২০০৭ সালের ২০ শে অগাস্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আওতাধীন একনেকের বৈঠকে ১০ হাজার ১৬১ কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়।

অনেক জল্পনা – কল্পনা শেষে ২০১৪ সালের ৭ই ডিসেম্বর পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরু হয়।নির্মাণের শুরুর দিকে প্রথম স্প্যান বসানো হয় ২০১৭ সালের ৩০ শে সেপ্টেম্বর।দক্ষিণী জেলা শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে ৩৭ এবং ৩৮ নং পিলারের উপর ভাসমান ক্রেনের সহায়তায় প্রথম স্প্যাম বসানো হয়।

পদ্মা সেতুর অফিসিয়াল নাম “পদ্মা বহুমুখী সেতু”।চায়না মেজর ব্রীজ ইন্জিনিয়ারিং কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডের সাহায্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়।সেতুটির মোট দৈর্ঘ্য ৬.১৫ কিলোমিটার ( ২০,২০০ ফুট),প্রস্থ ১৮.১০ মিটার (৫৯.৪ ফুট)।মাওয়া এবং জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতু নির্মাণ করা হয়।সেতুটিতে মতট ৪২ টি পিলার ব্যবহার করা হয়।

দুটি পিলারের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৫০ মিটার।পদ্মা সেতুতে মোট স্প্যান সংখ্যা ৪১ টি।২০২০ সালের ১০ই ডিসেম্বর ১২ ও   ১৩ পিলারের উপর শেষ স্প্যান বসানো হয়।বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতু রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বভার বহন করেন।প্রায় ৯১৮ হেক্টর জমির উপর পদ্মা সেতু নির্মিত হয়।৪ লেনের এ সেতু নির্মাণে মোট ব্যয় করা হয়েছে ৩০ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।২৮৬ পাইলের পদ্মা সেতুর সড়ক পথের নিচে রেলপথ দৃশ্যমান আছে।

পদ্মা সেতুর প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মোঃ শফিকুল ইসলাম।পদ্মা সেতুর লিড ডিজাইনার ব্রিটিশ নাগরিক রবিন শ্যাম।যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এইকম পদ্মা সেতুর নকশা তৈরী করেছেন।১৪ জুন ২০২২ স্বপ্নের পদ্মা সেতুর উপর একযোগে ৪১৫ টি বাতি জ্বালানো হয়।পদ্মা সেতু তত্ত্বাবধান এবং রক্ষণাবেক্ষণে কোরিয়া এক্সপ্রেশ ওয়ে কর্পোরেশন,বুয়েট এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অবদান দেশের ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

গত ২৫-০৬-২০২২ ইং মাওয়া প্রান্তে পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী ফলক ও বঙ্গবন্ধুর মূর‍্যল – ১ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করেন প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা।দুপুর ১২ টা নাগাদ সেতু উদ্বোধন করেন তিনি।এরপর গাড়ি যোগে শরিয়তপুরের জাজিরা প্রান্তে যান।সেখানে তিনি পদ্মাসেতুর উদ্বোধনী ফলক ও বঙ্গবন্ধু মূর‍্যল – ২ স্হাপন করেন।এরপর প্রধাণমন্ত্রী মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার কাঁঠালবাড়িতে ১০ লক্ষাধিক জনগণের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন।এসময় সেখানে উপস্থিত ছিলেন  বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।এছাড়াও সেখানে আওয়ামীলীগের সম্মানিত নেতাবৃন্দ উপস্হিত ছিলেন।প্রধাণমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুতে প্রথম টোল প্রদান করেন।

২৬-৬-২০২২ ভোর ৬ টা থেকে পদ্মা সেতুতে যান চলাচলের জন্য অনুমতি দেওয়া হয়।ঐদিন প্রথম ৮ ঘন্টায় ১৫ হাজার ২০০ যানবাহন থেকে টোল আদায় হয় ৮২ লাখ ১৯ হাজার টাকা।টোল আদায়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় কোরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে কর্পোরেশনকে।পদ্মা সেতুতে গাড়ি চলাচলের সব্বোর্চ গতিসীমা ঘন্টায় ৬০ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু বাংলাদেশের প্রথম সেতু যেখানে রেলপথ এবং সড়কপথ একই সাথে দৃশ্যমান।বিশ্বের ১২২তম অবস্হানে আছে পদ্মা সেতু যা সুইডেনের অল্যান্ড ব্রীজকেও  পেছনে ফেলেছে।

পদ্মা সেতুর দৃশ্যমানে বাংলাদেশের মূল কেন্দ্রের সাথে দক্ষিণ – পশ্চিম অংশের সরাসরি সংযোগ তৈরী হয়।দেশের অর্থনৈতিক ও শৈল্পিক বিকাশে যা উল্লেখযোগ্য অবদান রাখতে সক্ষম হবে।পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন ৩ কোটিরও অধিক জনগণকে উপকৃত করবে।যা দেশের জিডিপি ১.২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।পদ্মা সেতু বাংলাদেশের একটি অহংকারের নাম।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top