প্যানজিওস ভাসমান শহর কি সত্যিই আছে! সারা বিশ্ব যখন অর্থনৈতিক মন্দা নিয়ে চিন্তিত তখন সৌদি আরব বিশ্বের বড় জাহাজ নির্মাণের স্বপ্নে বিভোর। বর্তমান বিশ্বকে সৌদি আরব একের পর এক বিস্ময়কর প্রকল্পের মাধ্যমে তাক লাগিয়ে দিচ্ছে।
দ্য নিওম এরপর বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘতম জাহাজ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান। স্বপ্নটি সত্যি হলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজের তকমা করে নিবে সৌদি আরবের তৈরি প্যানজিওস। এই জাহাজে যাত্রীদের জন্য থাকবে না কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য। অর্থাৎ যাত্রীরা জাহাজের মধ্যেই সারাক্ষণ অবস্থান করবে।
বিশ্বের এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জাহাজের খেতাব ধরে রাখা টাইটানিকের দুই গুণ বড় হবে প্যানজিওস। সামুদ্রিক কচ্ছপের মতো দেখতে জাহাজটি এতটাই বড় হবে যে এটিকে ভাসমান শহর বা ফ্লোটিং সিটিও বলা হচ্ছে।
ইতালিয়ান কোম্পানি লাখজারিনি এর ডিজাইন করেছে। প্যানজিওস হবে একটি ভাসমান শহর এবং এটি সমুদ্রের মাঝে প্রায় ৬০ হাজার যাত্রী নিয়ে সমুদ্রের বুকে ভেসে বেড়াবে। এই জাহাজটি এতটাই বর হবে যে বাংলাদেশের দুইটি মিরপুর স্টেডিয়াম ডুকে যাবে এর ভিতর। জাহাজটিতে কেউ ঘুমালে ঘুম থেকে উঠে মনে হবে এখনো রাতি আছে।
কেননা জাহাজটিতে আপনি যখন ঘুমাবেন এক স্থানে তখন ঘুম থেকে উঠে দেখবেন আপনি চলে এসেছেন আরেক স্থানে। জাহাজটি নির্মাণ করতে প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার খরচ হবে বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন প্যানজিওস নির্মাণকারী কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশী টাকায় এর পরিমাণ প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার বেশি। কর্তৃপক্ষের দাবি দানবীয় এই ভাসমান জাহাজ থাকবে এপার্টমেন্ট, হোটেল, শিক্ষা ব্যবস্থা, চিকিৎসা সেবা সহ এয়ারক্রাফ স্পোর্ট ও অন্যান্য সকল নাগরিক সুবিধা। প্রকল্পটির নাম দেওয়া হয়েছে দ্য টেরিয়াস প্রজেক্ট। আমরা আজকে এই পোস্টের মাধ্যমে আপনাদেরকে জানাবো সৌদি আরবের ভাসমান জাহাজ প্যানজিওস নির্মাণের আদ্যোপান্ত সম্পর্কে।
টেকটনিক প্লেট
সমুদ্রের বুকে দানব আকৃতির জাহাজটির নাম করা হয়েছে সুপার কনটিনেন্ট প্যানজিওসের নাম অনুসারে। প্যানজিওস নামটি শুনতে অবাক লাগলেও এই সুপার কনটিনেন্ট ভেঙেই ভূপৃষ্ঠের উপরেই গড়ে উঠেছে আজকের মানব সভ্যতা।২০-৩৩ কোটি ৫০ লক্ষ বছর আগে অবস্তিত ছিল এই সুপার কনটিনেন্টে।
ভূপৃষ্ঠের উপরের স্তরে টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ায় প্যানজিওস ভেঙ্গে সাতটি মহাদেশের উৎপত্তি হয়েছে। এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা ,ওশেনিয়া ও এন্টারটিকা। সবগুলো মহাদেশই প্যানজিওস ভূখণ্ডে অংশবিশেষ।
নিওম প্রজেক্ট
লাগজারিনি ডিসাইনারদের ভাবনাতেও প্যানজিওসের স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। সৌদি আরব ও দুবাই সহ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রধান আয়ের উৎস হচ্ছে খনিজ সম্পদ তেল।
এই দেশগুলো থেকে দিন দিন তেলের মজুদ কমে যাচ্ছে তাই মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো তেলের উপর নির্ভর অর্থ ব্যবস্থাকে পাল্টিয়ে বাণিজ্যিক ও পর্যটন কেন্দ্র করতে শুরু করেছে। ইতোমধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই, বুস খলিফা, পাম জুমেরা কিংবা বিশ্বের প্রথম সেভেন স্টার হোটেল বুজ আল আরব তৈরি করে শতভাগ সফলতা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সৌদি যুবরাজ সৌদি অর্থনীতি বহুমুখী করার লক্ষ্যে নিওম প্রজেক্ট এবং নিউ মুরাবা মেগা প্রকল্পের উদ্বোধন করে পুরো বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। এবার আরো বড় চমক হিসেবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে এসেছেন।
প্যানজিওস পরিকল্পনা
২০০৯ সালে সর্বপ্রথম প্যানজিওস পরিকল্পনা শুরু হয়েছিল। কিন্তু সকল জায়গায় এটি তৈরি করা সম্ভব নয়। পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক এবং দক্ষ কর্মীদের নিয়ে নকশা করা হয় প্যানজিওসের।
কিন্তু এটা নির্মাণের জন্য পর্যাপ্ত সুজক সুবিধা প্রয়োজন। তাই এই ভাস্যমান শহরটি নির্মাণের আগে এর নির্মাণ কারখানার জাগায় হিসেবে সৌদিআরবকে বেছে নেওয়া হয়েছে। জাহাজটি নির্মাণের জন্য প্রথমে অন্তত ১ বর্গ মিটার সাগরে একটি গোলাকার বাধ নির্মাণ করতে হবে। তাই এর সম্ভাব্য স্থান হিসেবে সৌদিআরবের জেদ্দা থেকে ৮১ কিলোমিটার উত্তরে অবস্থিত কিং আব্দদুলা জাহাজ ঘাটি বেছেনিয়েছেন নির্মাণ কারিরা।
বিশাল আকৃতির জাহাজটির দৈর্ঘ্য ৫০ মিটার বা ১৮শ ফুট এবং প্রস্থ হবে ৬১০ মিটার বা ২ হাজার ফুট। এটি আকারে এতোটাই বর যে বাংলাদেশের মিরপুর স্টুডিয়ামের মত ২টি স্টুডিয়াম ডুকে যাবে। জাহাজটির নিচে থাকবে ৩০ জাহার সেল যা পুরো জাহাজটিকে ভাসিয়ে রাখতে সাহায্য করবে। এছাড়া জাহাজের বেসম্যান নির্মাণে ব্যবহার করা হবে স্টিল।
প্যানজিওসে বসবাস করবে ৬০ হাজার মানুষ
স্থলের আরো দশটি শহরের মতো ছোট ছোট ব্লকে ভাগ করা থাকবে প্যানজিওস। এই জাহাজটিতে ব্যবহার করা হবে নয়টি এইচটি এইচ ইঞ্জিন। এবং প্রত্যেকটি মোটর বৈদ্যুতিক ১৬ হাজার ৮০০ এইচপি ক্ষমতা সম্পন্ন হবে।
পাখায় থাকা ইঞ্জিনগুলো সমুদ্রের ঢেউ থেকে উৎপন্ন করবে শক্তি। যার ফলে চলার জন্য অতিরিক্ত জ্বালানির প্রয়োজন পড়বে না। বিভিন্ন এনার্জির স্টোর ইনবোর্ড এনার্জি সোর্স থেকে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপন্ন করবে এবং জাহাজটি সর্বোচ্চ ৫ নটিকেল গতিতে চলতে পারবে। জাহাজটিতে ৬০ হাজার মানুষ বসবাস করতে পারবে। এটি মূলত জাহাজ হলেও শহরের আদলে তৈরি করা হবে। জাহাজটির মাঝখানে একটি বিশাল অংশ ফাঁকা রাখা হবে।
এটি মূলত এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে চলাচলের জন্য এবং এর মাঝামাঝি অংশে একটি সিপ্ট এয়ার থাকবে। সিপ্ট এয়ারটি সরাসরি সমুদ্রের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। ৩০ টি আন্ডার ওয়াটার অ্যাপার্টমেন্ট থাকবে যেখান থেকে সরাসরি সমুদ্রের তলে মনমুগ্ধকর দৃশ্যগুলো উপভোগ করা যাবে।
সাধারণ apartment, vip apartment এবং duplex অ্যাপার্টমেন্ট সহ ৬৪ টি অ্যাপার্টমেন্ট থাকবে। পাশাপাশি থাকবে চল্লিশটি লাখজারিয়াস ভিলা। আরো থাকবে লাগজারিয়াস হোটেল,শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, শপিং মল, পার্ক, বিনোদন ক্লাব সহ সকল প্রকার সুযোগ সুবিধা। এর বাইরে গাড়ি চলাচলের জন্য থাকবে রাস্তা।
ভার্চুয়াল প্যানজিওস
প্যানজিওস জাহাজে সকল ধরনের সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হবে যা উন্নত দেশে থাকে। এখানে কৃত্রিমভাবে গাছ লাগিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করা হবে। এছাড়াও কৃত্রিমভাবে সোলার প্যানেল বসিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা হবে।
জাহাজটির নকশা যেহেতু একটি কচ্ছপ আকৃতির তাই এটি যখন সমুদ্রে ভেসে চলবে তখন বিশাল আকৃতির একটি কচ্ছপের মতো দেখা যাবে। এটি চলার সময় হুবহু কচ্ছপের আকৃতি ধারণ করবে। ২০৩৩ সালে এর নির্মাণ কাজ শুরু করার পরিকল্পনা করেছে লাগযারিণী। এই জাহাজটির নির্মাণ কাজ শেষ করতে ৮ বছর সময় লাগবে।
যদি এই বিশাল প্রজেক্টটি বাস্তবায়িত হয় তাহলে প্যানজিওস জাহাজটি বিশ্বের সর্ববৃহৎ জাহাজের খেতাব অর্জন করে নিবে। এটি দেখতে যেমন সুন্দর হবে ঠিক এখানে বসবাস করাও অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। এখানে শুধুমাত্র বিশ্বের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিরা বসবাস করতে পারবে।
তবে আপনি চাইলে বর্তমান সময়ে ঘুরে আসতে পারেন প্যানজিওস। কেননা এই জাহাজটির নির্মাণ ফান্ডিং অংশ হিসেবে ১৬ ডলার খরচ করে একটি ভার্চুয়াল টিকিট কিনে ভার্চুয়াল প্যানজিওস ঘুরে দেখতে পারবেন যে কেউ। (প্যানজিওস ভাসমান শহর কি সত্যিই আছে)
বন্ধুরা আপনারা কি মনে করেন সৌদি আরব এই মেগা প্রকল্পটি শুরু করতে পারবে। কেননা ইতিমধ্যে সৌদি আরবের অনেক বড় বড় মেঘা প্রজেক্ট চলমান অবস্থায় রয়েছে। আর এর সাথে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় জাহাজ নির্মাণ প্রকল্প হাতে নিলে দরকার বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। আপনি যদি সৌদি আরবের চলমান বিগেস্ট প্রকল্পগুলো যেমন নিওম সিটি এবং নিউমুরাবা সম্পর্কে জানতে চান তাহলে আমাদের পরবর্তী পোস্টটি ফলো করুন ধন্যবাদ।