মিশরীয়রা কিভাবে মমি তৈরি করতো মিশরীয়রা কিভাবে মনি তৈরি করতো! প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতায় মৃতদেহ প্রাকৃতিকভাবে ধ্বংস অথবা ক্ষয়প্রাপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করতে মমি তৈরি করা হত। প্রায় তিন থেকে চার হাজার বছর আগের বহু মৃতদেহ এখনো অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। তারা কিভাবে এত দীর্ঘ সময় মৃতদেহ সংরক্ষণ করে রাখতো তা সত্যিই বিস্ময়কর।
তবে মমি তৈরির প্রক্রিয়া এখন আর কোন রহস্য নয়। প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ইজিবটোলোজিরা বহু গবেষণার পর মনি তৈরির রহস্য উদঘাটন করতে পেরেছে। আমরা আজকের এই পোস্টের মাধ্যমে প্রাচীন মিশরীয়দের মমি তৈরির প্রক্রিয়া সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব। আপনারা যারা মমি তৈরি রহস্য জানতে চান তারা পুরো পোস্টটি পড়বেন।
মিশরীয়দের মমি তৈরি করার কারণ
প্রাচীন মিশরীয়দের বিশ্বাস মৃত্যুর পর মৃত ব্যক্তিরা বেশ কিছু ধাপ অতিক্রম করে। তাদের একটি ধারণা ছিল তারা মৃত্যুর পর মহাপ্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে থাকে।
সেজন্য তাদের মৃতদেহকে প্রভুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য চমৎকারভাবে তৈরি করা হতো। তারা মনে করত মৃত্যুর পর একজন মৃত ব্যক্তিকে ৪২ জন দেবতার সামনে উপস্থাপন করা হয়। সেখানে মৃত ব্যক্তির হৃদপিণ্ড পরিমাপ করা হয়। কারো হৃদপিণ্ড ভাড়ি হলে সেই ব্যক্তিকে অত্যাচারী এবং খারাপ লোক বলে মনে করা হতো।
তাকে সঙ্গে সঙ্গে দেবতারা ধ্বংস করে দিত। আর যায় হৃদপিণ্ড হালকা তাকে দেবতারা সঙ্গে সঙ্গে সুখের সাগরে অর্থাৎ জান্নাতে প্রবেশ করাতো। এরকম ধারণার কারণেই মিশরীয়রা মৃত্যুর পরবর্তী প্রস্তুতিকে বেশ গুরুত্ব দিত।
তারা আরো মনে করত মৃত্যুর পর তাদের মৃতদেহ যতদিন পর্যন্ত সংরক্ষিত থাকবে ততদিন তারা স্বর্গে বাস করবে আর এ কারণেই নশ্বর দেহকে স্থায়িত্ব করার জন্য তারা মমি তৈরি করা শুরু করে। বিশেষ প্রক্রিয়া মৃতদেহ সৎকারের একটি ধারা হলো মনিফিকেশন বা মমি করা। কোনো মৃতদেহকে মমি করার উদ্দেশ্য হলো মৃত ব্যক্তির আত্মা ও শরীর পরজনমে প্রবেশ করতে সহায়তা করা। তাদের ধারণা অনুযায়ী এর মাধ্যমে তারা পবিত্রতা অর্জন করে।
প্রথম দিকে শুধু রাজাদের মৃতদেহকে মমি করা হতো। কারণ মিশরীয়রা মনে করত রাজারা মারা যাওয়ার পর মৃতদের রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করে। তবে পরবর্তীতে প্রাচীন মিশরের ব্যক্তিবর্গ এবং বৃত্তশালী লোকদেরকেও মমি করা হয়েছে।
মমি তৈরীর প্রক্রিয়া মিশরীয়রা কিভাবে মমি তৈরি করতো
মমি তৈরি করার জন্য দীর্ঘ এক আচার অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই কাজগুলো করা হতো অত্যন্ত গোপনে। প্রক্রিয়াটি ৭০ দিন যাবত চলমান ছিল। মমি তৈরির কাজ শুরু হয় কোন ব্যক্তি মারা যাওয়ার চতুর্থ দিন থেকে। মমি তৈরির প্রথম দিকের ধাপগুলো খুবই ভয়ংকর এবং অস্বাস্থ্যকর।
প্রথমে ব্যক্তির নাকের মধ্য দিয়ে একটি হুক প্রবেশ করিয়ে মস্তিষ্ক বের করে আনা হতো। এরপর শরীরের বাম দিকের অংশ কেটে ভেতরের সকল অঙ্গ প্রত্যঙ্গ বের করে ফেলা হতো। এরপর পুরো শরীর বিশেষ ধরনের মদ দিয়ে ধৌত করা হতো। তারপর বিভিন্ন ধরনের ভেষজ এবং সুগন্ধি দ্রব্যের থলে শরীরের ভেতরে ভরে দেওয়া হতো। শরীরের ভেতরে অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বের করে ফেলা হলেও হৃদপিণ্ডকে জায়গা মতো রেখে দেওয়া হতো। কারণ তারা মনে করত হৃদপিণ্ড হচ্ছে একজন ব্যক্তির সকল জ্ঞানের ভান্ডার।
কোন ব্যক্তি তার হৃদপিণ্ড ছাড়া কবরে যেতে পারবে না। এছাড়া তারা বিশ্বাস করত মৃত্যুর পর হৃদপিণ্ড পরিমাপ করে একজন ব্যক্তি সফলতা ও ব্যর্থতার দিক পরিমাপ করা হতো। হৃদপিন্ড শরীরের ভেতরে রেখে সেলাই করে দেওয়ার পর সম্পূর্ণ শরীরে ভেজিটেবল ওয়েল মাখানো হতো। মৃতদেহ পরিষ্কার করার পর এই প্রক্রিয়া শেষ করতে প্রায় ১৪ দিনের মতো সময় লাগতো।
মমিকে চৌবাচ্চায় অবস্থান করানো
মৃতদেহ পরিষ্কার করার প্রাথমিক অবস্থা শেষ হওয়ার পর দেহটিকে একটি চৌবাচ্চায় অবস্থান করা হতো। এই চৌবাচ্চাকে নেট্রো নামক এক ধরনের লবণ দিয়ে পূর্ণ করা হতো।
এরপর লবণ সহ দেহকে রোদে শুকানো হত। লবনের মিশ্রণ এবং মৃতদেহের শরীরের পানি শুকাতে প্রায় ৪০ দিনের মতো সময় লাগতো। শরীরের ভেতরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গুলো আলাদা ভাবে একই প্রক্রিয়া শুকানো হতো। এরপর সেগুলোকে চারটি পাত্রে ভরে মমির সঙ্গে রেখে দেওয়া হতো। এসব পাত্রকে বলা হতো কেনপিকজার। শরীর শুকিয়ে যাওয়ার পর আবারো সম্পূর্ণ শরীরে এক ধরনের মলম লাগানো হত।
লেলিন কাপড় এ মমিকে পেঁচানো
মৃতদেহ প্রস্তুতকরণের ভেষজ প্রক্রিয়ার শেষ হওয়ার পর শুরু করা হতো মমি বাধার কাজ। মমিকে প্যাচানোর জন্য বিশেষ ধরনের লেলিন কাপড় ব্যবহার করা হতো। ব্যক্তি ভেদে এই কাপড়ের মান আলাদা হতো।
যে সব ব্যক্তি ধনী ছিল তাদেরকে সর্বোচ্চ মানের লেলিন কাপড় দেওয়া হতো এবং অপেক্ষাকৃত গরিবদের নিম্নমানের লেলিন কাপড় দিয়ে মুরানো হত। একটি মৃত দেহকে বিশ পরত কাপড় দিয়ে পেঁচানো হতো। আর এ কারণে শত শত গস লেলিনের দরকার হতো। মমির শরীর বাধাই করতে প্রায় ১৪দিন সময় লাগতো।
দেহ পেছানোর প্রতিটি পড়তে পড়তে তাবিজ কবজ বেঁধে দেওয়া হতো। এর উদ্দেশ্য ছিল কবরে যাওয়ার পর দেহ যেন আবারও পুনরায় জেগে উঠতে পারে। এই সকল প্রক্রিয়া শেষ করে মণিকরণ সম্পূর্ণ করতে প্রায় ৭০ দিন সময় লাগে। এরপর এসব মমিকে তাদের সুরক্ষিত কবরে স্থাপন করা হতো।
মমিকে বিভিন্ন কফিনে স্থানান্তর
তাদের বিশ্বাসমতো সেখান থেকেই মৃত ব্যক্তিরা পরজনমে পদার্পণ করে। মমি তৈরির মাধ্যমে মৃতদেহকে শারীরিকভাবে সুরক্ষিত করার পাশাপাশি হাওয়া জনিত ক্ষয় রোধ করনে বিশেষ ধরনের কফিনে মৃতদেহ স্থাপন করা হত। মাটির অনেক গভীরে সুরক্ষিত কবর নির্মাণ করে তার ভিতরে কফিনগুলোকে রাখা হতো।
এখনো পর্যন্ত বেশ কয়েক ধরনের কফিন পাওয়া গেছে। তৎকালীন সময়ের অতি উচ্চ বৃত্তশালী ব্যক্তিদের জন্য একাধিক কফিন ব্যবহার করা হতো। একটি কফিনের মধ্যে আরেকটি কফিন দিয়ে সমাধিকরণের প্রক্রিয়াক বলা হয় nestate কফিন। তবে এর চেয়েও একটি অবাক করা বিষয় হলো বেশ কিছু পাথরের কফিন পাওয়া গেছে। এসব পাথরের কফিনকে বলা হয় ছারকফেকাস।
প্রাচীন মিশরের মন্ত্রী বা রাজসভার গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদেরকে এসব পাথরের কফিনের মধ্যে সমাহিত করা হতো। পাথরের কফিনগুলোকে মাটির প্রায় দেড়শ ফিট নিচে রাখা হতো।
মমির সঙ্গে প্রচুর ধনসম্পদ মাটিতে পুতিয়ে রাখা
মিশরীয়রা মনে করত মারা যাওয়ার পরেও মানুষের ধন-সম্পদ সহ বিভিন্ন জিনিসের প্রয়োজন হয়। আর সে কারণেই এসব বৃত্তশালী ব্যক্তিদের কফিনে প্রচুর পরিমাণে সোনা-রূপাসহ মূল্যবান সম্পদ রেখে দেওয়া হতো।
আর এ কারণেই সেই সময়ে এসব কবর ছিল চোর ডাকাতদের অন্যতম টার্গেট। গবেষকরা অনেক কবরের ভিতরে পর্যালোচনা করে দেখেছেন যারা এসব সুরক্ষিত কবর খনন করেছে তারাও পরবর্তীতে গোপনে সেখান থেকে ধন সম্পদ চুরি করে নিয়ে গেছে।
প্রাচীন মিশরের মমিকে আবহাওয়া থেকে সুরক্ষা দিতে সর্বোচ্চ ব্যবস্থা ছিল পিরামিড নির্মাণ। সাধারণত মিশরের রাজাদের মমি সংরক্ষণের জন্য পিরামিড তৈরি কর হয়। হাজার হাজার বছর ধরে মিশরের পিরামিড ছিল মানুষের তৈরি সবচেয়ে বড় এবং বিস্ময় কর স্থাপনা। পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্যের সবচেয়ে প্রাচীন নিদর্শন পিরামিড সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের পরবর্তী পোস্টটি ফলো করতে পারেন।