হাতির দাঁত বিক্রি করে চোরাশিকারীর মাসে আয় ৭৫ লাখ টাকা

হাতির দাঁতের দাম কত! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় স্থলচর প্রাণী হাতি। এদের শারীরিক সৌন্দর্যের অন্যতম অংশ হলো এদের দাঁত। যা গজ দন্ত নামে পরিচিত।

হাতির দাঁতের দাম কত

যদি প্রশ্ন করা হয় হাতির দাঁত কয়টি তাহলে বেশিরভাগ মানুষে উত্তর দিবে দুইটি।কিন্তু না হাতির সাধারণত ২৬ টি দাঁত থাকে। হাতি যে দাঁতগুলো দিয়ে খাবার খায় সে দাঁতগুলোকে আমরা দেখতে পাই না। বাইরে থেকে যে দুটি দাঁত দেখা যায় ঐ দুটি আসলে শোভা বর্ধনকারী দাত। আর এই সৌন্দর্যমন্ডিত দাঁত দুটি হাতির কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

প্রাচীন কাল থেকে হাতির দাঁত দিয়ে শিল্পকর্ম ও বিলাসী পণ্য সামগ্রী তৈরি করা হতো। প্রতিবছর শুধুমাত্র হাতির দাঁত সংগ্রহ করার জন্য ৩০ হাজারেরও বেশি হাতি হত্যা করা হয়। এভাবে হাতির বাণিজ্য চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে হাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। হাতির দাঁতের অবৈধ বাজার কিভাবে পৃথিবী থেকে হাতিকে বিলুপ্ত করে দিচ্ছে সে সম্পর্কে আজকে আমরা আলোচনা করব আমাদের এই পোস্টটিতে। বন্ধুরা হাতি সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের পোস্টটি স্ক্রিপ্ট না করে পুরোটি পড়ার অনুরোধ রইল।

হাতির দাঁত দিয়ে শিল্পকর্ম

পৃথিবীতে প্রধানত দুই ধরনের হাতির আছে। আফ্রিকান হাতি এবং এশিয়ান হাতি। এই দুই প্রকারের হাতির মধ্যেও কিছু উপপ্রজাতি দেখা যায়। পৃথিবীতে বিচরণ করা সব থেকে বড় প্রাণী হল আফ্রিকান হাতি। হাতি সাধারণত ৬০ থেকে ৭০ বছর বেঁচে থাকে। হাতির দলের মধ্যকার সদস্যদের যোগাযোগ অত্যন্ত সক্রিয়।

হাতি তাদের জীবন দশায় অর্জিত জ্ঞান পরবর্তী প্রজন্মের মধ্যে রেখে যায়। হাতি অনেকটা মানুষের মতই আবেগপ্রবণ প্রাণী। কোথাও কোন হাতি মারা গেলে জীবিত হাতিরা মৃত হাতিকে দেখতে আসে। খ্রিস্টপূর্বক দুই থেকে আড়াই হাজার বছর আগে থেকেই হাতির দাঁত দিয়ে শিল্পকর্ম তৈরি করার পদ্ধতি জনপ্রিয় ছিল। প্রাচীন ভারতীয় সিন্ধু সভ্যতা সহ বহু প্রাচীন রাজপ্রসাদে হাতির দাঁতের নানা প্রত্নবস্তু পাওয়া গেছে ।

বাংলাদেশে হাতির দাঁতের শিল্পকর্ম তৈরির তথ্য প্রমাণ পাওয়া যায় সিলেট অঞ্চলে। ভারতবর্ষের বাইরে গ্রিক লাতিন আরব ও চিনা সাহিত্যেও হাতির দাঁতের শিল্পকর্মের উল্লেখ আছে। হাতির দাঁত থেকে গলার মালা, আংটি ,হাতের চুরি, চিরুনি, খোঁপার কাটা, বোতাম, দাবার গুটি সহ অসংখ্য শিল্পকর্ম তৈরি করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন ধরনের মূর্তি, সোপিস, চেয়ার, টেবিল, সিংহাসনের পায়া এবং ঘর সাজানোর নানা উপকরণ তৈরিতে গজ দন্তের ব্যবহার রয়েছে।এ ধরনের বিলাসী দ্রব্য সামগ্রী তৈরি করার উদ্দেশ্যে সারা পৃথিবীতে বহু হাতি হত্যা করা হচ্ছে।

আফ্রিকান হাতির দাঁত

এশিয়ান হাতির তুলনায় আফ্রিকান হাতির দাত বেশ বড়। প্রাপ্তবয়স্ক আফ্রিকান হাতির দাঁত প্রায় সাড়ে ১১ ফুট পর্যন্ত লম্বা হতে পারে। সেজন্য বাণিজ্যিকভাবে হাতির দাঁত সংগ্রহের জন্য চোরাশিকারীরা আফ্রিকান হাতির পিছনে লেগেছে। ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিকভাবে হাতির দাঁতের ব্যবসা নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু তারপরও সামান্য কিছু টাকার জন্য এই প্রাণীগুলোকে নির্দয় ভাবে হত্যা করা বন্ধ হয়নি।

চোরা শিকারীরা প্রথমে গুলি করে হাতিকে হত্যা করে। এরপর মৃত হাতির মাথা কেটে দাঁত বের করে নেয়। একটি বড় হাতির দাঁতের ওজন প্রায় ১৫ কেজি পর্যন্ত হতে পারে। আফ্রিকার দরিদ্র জনগণ সাধারণত অতি মুনাফার আশায় হাতির শিকার করে। তারা একটি হাতির দাঁতের জন্য কেজিপ্রতি মাত্র ৬০০ টাকা পায়।

অথচ চীনে হাতির দাঁতের কেজি প্রায় আড়াই লক্ষ টাকার বেশি। অর্থাৎ একজন আফ্রিকান চোরা শিকারি হাতি মেরে সর্বোচ্চ ১৮০০০ টাকা পায়।আর আফ্রিকান মাফিয়ারা এই দাঁত চিনে বিক্রি করে প্রায় ৭৫ লক্ষ টাকা। এসব কাঁচা দাঁত থেকে যেসব পণ্য উৎপাদিত হয় তার মূল্য কয়েক কোটি টাকা। হাতির দাঁতের চোরাকারবারির সাথে জড়িতরা সমস্ত হাতি মেরে ফেলতে চায় পৃথিবী থেকে। যদি হাতির বিলুপ্ত হয়ে যায় তখন হাতির দাঁতের দাম বেড়ে যাবে কয়েকশ গুণ।

যে পণ্য যত দুর্লভ তার দামও তত বেশি। হাতির দাঁতের দাম যত বাড়তে থাকবে মানুষ হাতি শিকারের প্রতি তত বেশি আগ্রহী হবে। হাতির দাঁত থেকে উৎপাদিত পণ্য এর দাম প্রতিবছর প্রায় ২০% হারে বেড়েই চলেছে। সেজন্যই পাচারকারী সকল হাতি হত্যার না করা পর্যন্ত থামবে না।তারা পৃথিবী থেকে হাতির সম্পূর্ণ বিলুপ্তি চায়।

হাতির দাঁতের ব্যবসা অত্যন্ত লাভজনক। বিপুল পরিমাণ অবৈধ অর্থের কারণে পাচারকারীরা বিভিন্ন দেশের রাজনীতিবিদ, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য সহ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রভাবিত করতে সক্ষম হয়। হাতির দাঁত থেকে অর্জিত অর্থের একটি বড় অংশ বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদের পেছনে খরচ করা হয়। বর্তমান পৃথিবীতে গজ দন্ত শিল্পের প্রধান কেন্দ্রগুলো চীন এবং হংকং। চীনে হাতির দাঁতের বৈধ বাজার রয়েছে। সে কারণে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে হত্যা করা হাজার হাজার হাতির দাঁতের প্রধান গন্তব্য হল চীন। চীনের গজ  দন্ত শিল্পের সামান্য পরিমাণ বৈধ কাঁচামালের উপর নির্ভরশীল।

চীনে হাতির দাঁতের ব্যাবসা

চীন সরকার প্রতিবছর ৫ টন হাতির দাঁত এই ব্যবসার সাথে জড়িতদের মাঝে বিতরণ করে। কিন্তু চাহিদার তুলনায় যা  আতি নগণ্য। আর তাই এসব প্রতিষ্ঠান অবৈধ দাঁতের উপনির্ভরশীল। বিষয়টি সহজ করে বলতে গেলে মনে করুন, বাংলাদেশে কয়েকটি বৈধ মাদকের দোকান আছে। সেখানে সরকার অতি সামান্য পরিমাণ মাদক বৈধভাবে বিক্রির অনুমোদন দিয়েছে।

কিন্তু মাদকের প্রকৃত চাহিদা অনেক বেশি। তখন বৈধ মাদক ব্যবসায়ীরা কি করবে? তাদের মুনাফা বৃদ্ধির জন্য সরকারের বরাদ্দকৃত মাদকের চেয়েও বেশি মাদক বিক্রি করবে। আর অবশ্যই এই বাড়তি মাদকের যোগান আসবে অবৈধ পথে। ঠিক একই রকম ভাবে সমগ্র পৃথিবীতে হাতির দাঁতের ব্যবসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। শুধুমাত্র চীনে হাতির দাঁতের সামান্য পরিমাণ বৈধ মার্কেট রয়েছে। আর সেই বৈধ মার্কেটের আড়ালে সমগ্র পৃথিবীর সিংহভাগ হাতির দাঁত চীন থেকে প্রক্রিয়াজাত করা হয়। মাত্র ৫ টনের বৈধ বাজারের জন্য প্রতিবছর হাজার হাজার টন হাতির দাঁত চিনে প্রবেশ করছে।

চীনের পরেই সবচেয়ে বড় হাতির দাঁতের বাজার হলো যুক্তরাষ্ট্র। এছাড়া ইউরোপ ,থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ফিলিপাইন এবং মালয়েশিয়াতেও গজ দন্তের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। এভাবে হাতির বাণিজ্য চলতে থাকলে আগামী ১৫ বছরের মধ্যে আফ্রিকান হাতি সম্পূর্ণ বিলুপ্ত হয়ে যাবে। চীনে কিছু ব্যবসায়ীর কাছে হাজার হাজার টন হাতির দাঁত মজুত রয়েছে এবং তাদের এই সংগ্রহ বেড়েই চলেছে। কারণ তারা জানে হাতির দাঁতের মূল্য কখনো কমবে না বরং দিন দিন তা বাড়তেই থাকবে। মাত্র কয়েক বছর আগেও আফ্রিকায় লক্ষাধিক হাতি ছিল অথচ পাঁচ বছরের ব্যবধানে এখন ৫০ হাজার হাতিও নেই।

১০০ হাতি মানুষের হাতে মারা যাচ্ছে

আফ্রিকা থেকে এক একটি চালানে প্রায় তিন হাজার কেজি হাতির দাঁত পাচার করা হয়। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে ধরা পড়া কয়েকশো মিলিয়ন ডলার মূল্যের হাতির দাঁত মজুদ রয়েছে আফ্রিকার বেশ কয়েকটি দেশে। এসব দেশে বাজেয়াপ্ত হাতির দাঁত সরকারি গুদাম থেকে কালোবাজারে বিক্রি করারও নজির রয়েছে।

২০১৬ সালে কেনিয়ায় ১০৫ টন হাতির দাঁত পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে। আফ্রিকার অন্যান্য দেশের সরকারি গুদামে এখনো প্রায় ৬০০ টনেরও বেশি হাতির দাঁত মজুদ রয়েছে। আসার ব্যাপার হলো ২০১৮ সালের শুরুর দিকে চীনে হাতির দাঁতের ব্যবসা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা হয়। হাতি সংরক্ষণে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ তবে ।

আপনি এই পোস্টটি করার সময়ও হয়তো একটি হাতি মারা পড়েছে। কারণ প্রতি ১৫ মিনিটে একটি হাতি চোরাশিকারীর কবলে পড়ে এবং প্রতিদিন গরে প্রায় ১০০ হাতি মানুষের হাতে মারা যায়। বিশ্বের আর মাত্র ৪ লক্ষ হাতি অবশিষ্ট আছে বলেই ধারণা করা হয়। যখন হাতির দাঁত থেকে উৎপাদিত পণ্য কেনা বন্ধ হবে শুধুমাত্র তখনই হাতি হত্যা বন্ধ হতে পারে। তবে সেদিন খুব নিকটে নয় এভাবে চলতে থাকলে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো কখনো হাতি দেখতে পাবে না হাতি শব্দটি শুধু ইতিহাস হয়ে থাকবে তখন বাস্তবে নয় হাতি দেখা যাবে শুধু ছবিতে।

হাতির দাঁতের মতোই ব্যাপক হারে চীনে পাচার হওয়া একটি প্রাণী হল বনরুই। বনরুই একমাত্র আঁশযুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণী। চীন এবং ভিয়েতনামে বনরুইয়ের শরীরের আস থেকে ঐতিহ্যবাহী ঔষধ তৈরি করা হয়। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি অবৈধভাবে পাচার হওয়া প্রাণী বনরুই সম্পর্কে জানতে চাইলে আমাদের পরবর্তী পোস্টটি ফলো করুন ধন্যবাদ।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top